দেহের বৃদ্ধি, ভরণপোষণ ও উৎপাদনের জন্য খাদ্য গ্রহণ করা আবশ্যক । দানা শস্য ও এদের উপজাতসমূহ গৃহপালিত পাখির (হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। হাঁস-মুরগির খামার পরিচালনায় যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় তার ৭০ ভাগই খরচ হয় খাদ্য ক্রয় খাতে। নিম্নে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
১। দানাশস্য ও এদের উপজাতসমূহ তাজা ও মানসম্মত হতে হবে ।
২। খাদ্যে পাখির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকৰে ।
৩। খাদ্য জীবাণু, ছত্রাক ও পরজীবী মুক্ত হতে হবে।
৪। প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করে খাদ্য প্রস্তুত করতে হবে।
৫। খাদ্য সহজপাচ্য হবে।
৬। খাদ্য খুব সুস্বাদু হতে হবে ।
৭। খাদ্যের উৎপাদন খরচ কম হতে হবে ।
৮। খাদ্যকে যে কোনো প্রকার দুর্গন্ধযুক্ত হতে হবে।
৯। খাদ্য উপকরণ সহজলভ্য হতে হবে।
বিভিন্ন খাদ্য উপকরণ মিশ্রিত করে পাখির রেশন তৈরি করা হয়। রেশন হচ্ছে ২৪ ঘণ্টায় কোনো পশু বা পাখি দ্বারা গৃহীত খাদ্য । রেশন অবশ্যই পুষ্টি উপাদানে সুষম হতে হবে। যে রেশনে পাখির প্রয়োজনীয় শর্করা, আমিষ, চর্বি, খনিজ লবণ ও ভিটামিন উপস্থিত থাকে তাকে সুষম রেশন বলে। সুষম খাদ্য বা রেশনের কাজ নিম্নে দেওয়া হলো ।
১। খাদ্য বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
২। খাদ্য শরীরে শক্তি যোগায় ।
৩। খাদ্য দেহের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ।
৪। দেহের হাড় গঠনে সাহায্য করে ।
৫। দেহ কোষের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধন করে ।
৬। দেহের পানির সমতা রক্ষা করে ।
৭। দেহে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। ৮। দেহের রোগ প্রতিরোধ করে ।
৯। ডিম ও মাংস উৎপাদনে সাহায্য করে ।
মুরগির খাদ্য
যেহেতু মুরগি ডিম ও মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়, তাই ডিমপাড়া মুরগি ও ব্রয়লার মুরগির জন্য পৃথক রেশন তৈরি করা হয় । ডিমপাড়া মুরগি বা লেয়ার মুরগির ৩ প্রকার রেশনের নাম নিচে দেওয়া হলো।
১। লেয়ার স্টার্টার বা প্রারম্ভিক রেশন : ০-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত
২। বাড়ন্ত মুরগির রেশন : ৯-১৯ সপ্তাহ পর্যন্ত
৩। ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির রেশন: ২০-৭২ সপ্তাহ পর্যন্ত
ব্রয়লার মুরগিকে ৩ প্রকার রেশন সরবরাহ করা হয়:
১। ব্রয়লার স্টার্টার বা প্রারম্ভিক রেশন: ০-২ সপ্তাহ পর্যন্ত
২। ব্রয়লার গ্রোয়ার বা বাড়ন্ত বাচ্চার রেশন: ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত
৩। ব্রয়লার ফিনিশার রেশন: ৫-৬ সপ্তাহ পর্যন্ত
খাদ্য উপকরণ: মুরগির খাদ্য তৈরিতে প্রধানত দানাশস্য ও এদের উপজাত ব্যবহার করা হয় ৷ রেশন তৈরির জন্য দানাশস্য হিসাবে প্রধানত গম, ভুট্টা ও ভুসি ব্যবহার করা হয় । কিন্তু বসতবাড়িতে পারিবারিক মুরগি পালনে যে কোনো শস্যদানা যেমন, ধান, চাল, খুদ, ডাল, সরিষা ইত্যাদি মুরগিকে খেতে দেওয়া হয় । খাদ্য উপকরণের পুষ্টিমান, প্রাপ্যতা ও বাজারদর বিবেচনা করে রেশন তৈরির জন্য নির্বাচন করতে হবে । নিম্নে পুষ্টি উপাদানের বিষয় বিবেচনায় রেখে খাদ্য উপকরণের একটি তালিকা দেওয়া হলো ।
পুষ্টি উপাদান | খাদ্য উপকরণ |
শর্করা | গম, ভুট্টা, ধান, চাল, চালের কুড়া, গমের ভুসি ইত্যাদি । |
আমিষ | শুঁটকি মাছের গুঁড়া, তিলের খৈল, সরিষার খৈল, সয়াবিন মিল, রক্তের গুঁড়া ইত্যাদি |
স্নেহ | বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তৈল যেমন: পাম তৈল, তিলের তৈল, সয়াবিন তৈল ইত্যাদি । |
খনিজ পদার্থ | খাদ্য লবণ, ঝিনুক খোসা চূর্ণ, হাড়ের গুঁড়া, ডিমের খোসা, চুনা পাথর ইত্যাদি । |
ভিটামিন | শাকসবজি, ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স ইত্যাদি । |
পানি | পরিষ্কার বিশুদ্ধ জীবাণুমুক্ত পানীয় জল । |
মুরগির খাদ্য গ্রহণ: লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ মুরগির জাত, বয়স, তাপমাত্রা, খাদ্যের মান, বাসস্থান, খাদ্যের আকার ও পরিবেশনের উপর নির্ভর করে ।
বয়স | মুরগি (গ্রাম/দিন) | ব্রয়লার (গ্রাম/দিন) |
প্রথম সপ্তাহ | ১০ | ২৫ |
দ্বিতীয় সপ্তাহ | ২০ | ৬৫ |
তৃতীয় সপ্তাহ | ২৫ | ১০০ |
চতুর্থ সপ্তাহ | ৩০ | ১৩০ |
পঞ্চম সপ্তাহ | ৩৫ | ১৬০ |
ষষ্ঠ সপ্তাহ | ৩৭ | ১৬৫ |
সপ্তম সপ্তাহ | ৪০ | ------ |
অষ্টম সপ্তাহ | ৪৫ | ------ |
বাড়ন্ত | ৭০ | ------ |
বয়স্ক | ১১৫ | ------ |
কাজ : ১০০টি বাড়ন্ত লেয়ার মুরগি ৭ দিনে কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করবে শিক্ষার্থীরা এককভাবে তা হিসাব করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে । |
খাদ্য তৈরির নিয়মাবলি
গম বা ভুট্টাকে প্রথমে মেশিনে ভেঙে নিতে হবে। খৈলকেও ভালোভাবে গুঁড়া করে নিতে হবে। খাদ্য উপকরণ মাপার পাল্লা ব্যবহার করতে হবে । খাদ্য তৈরির জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে । প্রথমে গম বা ভুট্টা মেপে মেঝেতে ঢালতে হবে । তারপর চালের মিহিকুঁড়া ও গমের ভুসি, ভুসির উপর শুঁটকি মাছের গুঁড়া, তার উপর খৈল ও সয়াবিন মিল ঢালতে হবে। এভাবে সবগুলো উপকরণ ঢালার পর খাদ্যের স্তূপটিকে একটি পিরামিডের মতো দেখা যাবে। এবার ঝিনুকের গুঁড়া, হাড়ের গুঁড়া ও লবণ ঐ পিরামিডের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে । এবার আধা কেজি খাদ্য আলাদা করে নিয়ে তার মধ্যে ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স উত্তমরূপে মিশ্রিত করতে হবে। এরপর মিশ্রিত ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স পিরামিডের উপর সমস্ত খাদ্যে ছিটিয়ে দিতে হবে । সয়াবিন তৈল দেওয়ার প্রয়োজন হলে তা পিরামিডের চারদিকে ঢেলে দিতে হবে । এবার খাদ্যের স্তূপটির ভিতরে বার বার হাত ঢুকিয়ে সবগুলো উপকরণ ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে । মিশ্রিত এ খাদ্য বাদামি রঙের দেখাবে । মুরগির জন্য বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাদ্য বাজারে পাওয়া যায়। এসব খাদ্য অত্যাধুনিক ফিড মিলে তৈরি করা হয় । মুরগির বয়স ও উদ্দেশ্য অনুসারে বাজারে ম্যাশ (পাউডার), ক্র্যাম্বল (দানা) ও পিলেট (বড়ি) আকারের খাদ্য বাজারে কিনতে পাওয়া যায় ।
লেয়ার বা ডিমপাড়া মুরগির খাদ্য তালিকার বিভিন্ন খাদ্য উপকরণের মিশ্রণ-
উপকরণের নাম | শতকরা হার (%) |
গম/ভুট্টা ভাঙা | ৪৫-৫৫ |
গমের ভুসি | ৮-১২ |
চালের মিহিকুঁড়া | ১০-১৫ |
তিলের খৈল | ১০-১৫ |
শুটকি মাছের গুঁড়া | ১০-১২ |
ঝিনুক চূর্ণ ও হাড়ের গুঁড়া | ১.৫-৭ |
লবণ | ০.০৫ |
বিশেষ দ্রষ্টাব্য
১। ভিটামিন-খনিজ মিশ্রণ : উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিত মাত্রায় এ খাদ্যতালিকার সঙ্গে যোগ করতে হবে।
২। জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি : পর্যাপ্ত পরিমাণ
বিভিন্ন বয়সের ব্রয়লার মুরগির খাদ্য তালিকা
উপাদান | প্রারম্ভিক রেশন (%) | বৃদ্ধি রেশন (%) |
গম/ভুট্টা ভাঙা | ৫০ | ৫২ |
চালের মিহি কুঁড়া | ১৪ | ১২ |
তিলের খৈল | ১২ | ১০ |
শুঁটকি মাছের গুঁড়া | ১৪ | ১২ |
সয়াবিন মিল | ৮ | ৯ |
সয়াবিন তৈল | - | ২ |
হাড়ের গুঁড়া | ১.৫ | ২.৫ |
খাদ্য লবণ | ০.৫ | ০.৫ |
সর্বমোট | ১০০ | ১০০ |
বিশেষ দ্রষ্টব্য
১। ভিটামিন-খনিজ মিশ্রণ : উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিত মাত্রা খাদ্যতালিকার সঙ্গে যোগ করতে হবে ।
২। জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি : পর্যাপ্ত পরিমাণ
নতুন শব্দ : ভরণপোষণ, স্টার্টার রেশন, গ্রোয়ার রেশন, ফিনিশার রেশন, লেয়ার রেশন, ম্যাশ, ক্র্যাম্বলও পিলেট খাদ্য
হাঁসের খাদ্য
হাঁসকে জলজ পাখি বলা হয়। এরা খাল, বিল, পুকুর, হাওর ও নদীর ছোট জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে । হাঁস তৃণলতা এবং খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ খেয়েও ভালো উৎপাদন দিতে পারে । হাঁসের খাবারের সাথে পানি মিশিয়ে খাওয়াতে হয় । হাঁস শুষ্ক খাদ্যের চেয়ে ভেজা খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। তাই এদেরকে সবসময় গুঁড়া ও ভেজা খাদ্য দেওয়া উচিত। প্রথম ৮ সপ্তাহ হাঁসকে প্রচুর পরিমাণে খেতে দেওয়া উচিত । পরবর্তীতে সকালে ও সন্ধ্যায় দিনে দুইবার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। হাঁসের বাচ্চাকে জন্মানোর পর প্রথম কয়েক দিন হাতে তুলে খাওয়াতে হয় যাতে করে বাচ্চারা খাবার খাওয়া শিখতে পারে ।
বিভিন্ন খাদ্য উপকরণ মিশ্রিত করে মুরগির মতো হাঁসের রেশন তৈরি করা হয় । হাঁসের ৩ প্রকার রেশনের নাম নিচে দেওয়া হলো ।
১। হাঁসের বাচ্চার বা প্রারম্ভিক রেশন : ০-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত
২। বাড়ন্ত হাঁসের রেশন : ৫-১৯ সপ্তাহ পর্যন্ত
৩। ডিমপাড়া হাঁসের রেশন : ২০ সপ্তাহ থেকে বাকি সময় পর্যন্ত
হাঁসের খাদ্য গ্রহণ : হাঁসকে বয়স ও উদ্দেশ্য অনুসারে ৩ প্রকার রেশন সরবরাহ করা হয়। হাঁসের দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ হাঁসের জাত, বয়স, খাদ্যের মান, বাসস্থান ও খাদ্যের আকার ও পরিবেশনের উপর নির্ভর করে ।
বয়স | হাঁস (গ্রাম/দিন) |
প্রথম সপ্তাহ | ১৫ |
দ্বিতীয় সপ্তাহ | ২৫ |
তৃতীয় সপ্তাহ | ৩০ |
চতুর্থ সপ্তাহ | ৩৫ |
পঞ্চম সপ্তাহ | ৪০ |
ষষ্ঠ সপ্তাহ | ৪৫ |
সপ্তম সপ্তাহ | ৫০ |
অষ্টম সপ্তাহ | ৫৫ |
বাড়ন্ত | ৮৫ |
বয়স্ক | ১২৫ |
বিভিন্ন বয়সের হাঁসের রেশন
উপকরণের নাম | উপকরণের শতকরা হার (%) |
ভুট্টার গুঁড়া | ৪৫-৫০ |
ধানের কুঁড়া | ১০-১৫ |
খৈল | ১০-১৫ |
সয়াবিন মিল | ৮-১০ |
শুঁটকি মাছের গুঁড়া | ৮-১০ |
শামুকের খোসা চূর্ণ |
১.৫-৬.৫ |
খাদ্য লবণ. | ০.৫ |
কাজ : একটি বয়স্ক হাঁস ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত মোট কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করবে শিক্ষার্থীরা এককভাবে তা হিসাব করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে ।
আরও দেখুন...